যে শিরোনামে আজ দেওয়া হয়েছে, ঠিক হুবহু এই শিরোনামেই খবর প্রকাশ করেছিল পরিচিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউন। সেখানে তারা তুলে ধরেছিল এমপি লিটন ওরফে পিস্তল লিটন হত্যার পেছনে দেশের তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে জড়িয়ে দেয়ার মত পর্যাপ্ত গল্প। ভিত্তিহীন সেসব গল্পকে পুঁজি করে মহান জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী বললেন- ‘২০১৩, ১৪ ও ১৫ সালে সারা দেশে তারা আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে। লিটন বিএনপি-জামায়াতের ওই তাণ্ডবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে সুন্দরগঞ্জে শান্তি ফিরিয়ে দিয়েছিল। গোলাম আযম সুন্দরগঞ্জ গিয়েছিল মিটিং করতে। লিটন তাকে মিটিং করতে দেয়নি। আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছি, তারা সেই প্রতিশোধও নিতে চাচ্ছে। মনে হয়, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোটাই ছিল তার বড় অপরাধ। স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে লিটন।’
পিস্তল লিটনের নাম গণমাধ্যমে প্রথম সবেচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছিল সুন্দরগঞ্জের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী শিশু শাহাদাত হোসেন সৌরভকে গুলি করার পর।
পিস্তল লিটনের গুলিতে আহত শিশু সৌরভ
গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময় শিশু সৌরভের সাথে ছিল তার চাচা শাহজাহান। তিনি বলেন- ‘সাংসদ লিটন গাড়িতে বসেই জানালা দিয়ে আমাকে ইশারা করে ডাকেন। কিন্তু আমি ভয়ে তার কাছে না গিয়ে পালানোর চেষ্টা করি। এ সময় সাংসদ তার পিস্তল দিয়ে গুলি ছোড়েন। এতে সৌরভের ডান পায়ে দুইটি ও বাম পায়ে একটি গুলি লাগে।’
গুলিবিদ্ধ শিশু সৌরভ সাংবাদিকদের জানিয়েছিল- ‘আমার স্বাস্থ্য ভালো। তাই প্রতিদিন চাচার সঙ্গে সড়কে হাঁটাহাঁটি করি। দেখলাম একটি গাড়ি থেকে কে যেন আমার চাচাকে ডাক দিল। চাচা ভয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তখন ওই ব্যক্তি গুলি করেন। ওই গুলি আমার গায়ে লাগে। এরপর আমাকে লোকজন ধরাধরি করে হাসপাতালে নেয়।’
এরপর মিডিয়ায় উঠে আসে অবৈধ এমপি পিস্তল লিটনের নানা অপকর্মের খবর। নিয়মিত মদপানকারী এই আওয়ামী লীগ নেতার সেসব অপকর্ম একের পর এক প্রকাশিত হওয়ায় আততায়ীর গুলিতে নিহত হওয়ার পর জাতীয় সংসদে সাংবাদিকদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়াসহ আরও অনেকে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আখা কামাল আবেগে ভারী হয়ে আসা গদ গদ কণ্ঠে ঘোষণা করলেন- ‘লিটনের হত্যাকারী ও পরিকল্পনাকারীদের খুঁজে বের করতে পুলিশ কাজ করছে। তার হত্যাকারী ও হত্যার পরিকল্পনাকারীকে অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করা হবে।’
বলতে দেরি। কিন্তু করিৎকর্মা পুলিশের আর তর সয়না। শুধু গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ নয়। পুরো রংপুর বিভাগ জুড়ে চলে পুলিশের গণগ্রেফতারের তান্ডব। যার সবচেয়ে বেশি শিকার হয়েছিলেন ঐ অঞ্চলের জামায়াত শিবিরের নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা। উদ্দেশ্যমূলকভাবে গ্রেফতার করা হয়েছিল বিএনপির কিছু নেতা-কর্মীও। পিস্তল লিটনকে হত্যায় জড়িত দেখিয়ে শুধু গাইবান্ধায় পুলিশী তান্ডবে গ্রেফতার হয়েছেন ১৫৫ জন। যাদের মধ্যে অন্তত ১৪ জনকে গ্রেফতার না দেখিয়ে বেশ কিছুদিন গুম করে রাখা হয়েছিল। ওই ১৫৫ জনের মধ্যে শুধুমাত্র সুন্দরগঞ্জ থানায় গ্রেফতার দেখানো হয় ১৩৩ জন। এদের মধ্যে ২৩ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয় লিটন হত্যা মামলায়। বাকিদের কথিত বিস্ফোরক ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা নতুন চারটি মিথ্যা মামলা দিয়ে তাতে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। আদালত থেকে গণহারে দেয়া হয় রিমান্ডের আদেশ।
প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো প্রকার তদন্ত ছাড়াই পুলিশ বিরোধী মতের জনগণের উপর এমন গণগ্রেফতারের তান্ডব চালিয়েছিল কোন সাহসে? উত্তর খুবই সোজা। কোনো প্রকার তদন্ত ছাড়াই যদি সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রী এমপিরা ঢালাওভাবে জামায়াত-শিবিরকে দায়ী করে উত্তপ্ত বক্তব্য দিতে পারে, তাহলে পুলিশ গণগ্রেফতার চালাতে কেন মানবাধিকারের মত উটকো(!) একটা বিষয়কে প্রাধান্য দিবে?
জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে সেদিন আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত তো কোনো প্রকার রাখঢাক না রেখেই বলেছিলেন- ‘লিটনকে হত্যার মূল নায়ক হচ্ছে জামায়াত-শিবির-বিএনপি। এই হত্যার কোনো সাক্ষী লাগে না, প্রমাণ লাগে না। এক নম্বর আসামি বেগম খালেদা জিয়া। তাঁকে উত্তর দিতে হবে কেন লিটনকে হত্যা করা হলো।’
পিস্তল লিটন হত্যায় জামায়াতকে জড়িয়ে বিভিন্ন মিডিয়ার মিথ্যাচার:
এমপি পিস্তল লিটন নিহত হওয়ার পর জামায়াত-শিবিরকে জড়িয়ে সর্বপ্রথম মিথ্যা ও কাল্পনিক খবর প্রচার শুরু করে বাংলা ট্রিবিউন। এরপর তাদের প্রচারিত এসব তথ্য হুবহু কপি পেস্ট করে প্রচার করে বেশ কয়েকটি পত্রিকা। বাংলা ট্রিবিউন যা লিখেছে তা হলো- ‘স্থানীয়রা জানান, স্বাধীনতার আগে থেকেই রাজনৈতিকভাবে সুন্দরগঞ্জ এলাকা জামায়াত অধ্যুষিত ছিল। এ এলাকায় আওয়ামী লীগ ছিল খুবই দুর্বল। বছরের পর আধিপত্য বিস্তার করে থাকলেও জামায়াতের সে দুর্গে ফাটল ধরিয়েছিলেন এমপি লিটন। ১৯৯৮ সালে বামনডাঙ্গা কলেজ মাঠে গোলাম আযমের জনসমাবেশ ঠেকানোর মাধ্যমে জামায়াতের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে লড়াই শুরু করেছিলেন তিনি। তখন থেকেই জামায়াত-শিবিরের প্রধান শত্রুতে পরিণত হন। ২০১৩ সালে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর জামায়াতকে পুরোপুরি কোণঠাসা করে ফেলেন। জামায়াত-শিবিরও তাকে একমাত্র পথের কাঁটা মনে করতো। যে কারণে বিভিন্ন সময় নানা ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি তাকে দেখে নেওয়ারও হুমকি দিয়েছিল তারা। লিটনের মৃত্যুতে সেই জামায়াত-শিবিরই সবচেয়ে বেশি বেনিফিসিয়ারি হলো বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।’
উপরে উল্লিখিত অংশটুকুই পরবর্তীতে কপি করে মিথ্যাচার করেছে দেশের প্রায় সকল ইলেক্ট্রনিক্স, প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়া। এমনকি নিহত পিস্তল লিটনের স্ত্রীও হুবহু এই কথাগুলোই মিডিয়ার কাছে বলেছে। এবং লিটন হত্যায় সরাসরি জামায়াতকে দায়ী করেছে।
চলুন দেখে নেয়া যাক অন্যান্য পত্রিকাগুলো এ সংক্রান্ত খবরে কীভাবে উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যাচার করেছিল।
উপরের প্রত্যেকটি রিপোর্টেই ছিল বাংলাট্রিবিউনের সেই খবরেরই প্রতিচ্ছবি। প্রত্যেকেই ঘুরে ফিরে অনুমান বশত: দায় চাপিয়েছেন জামায়াত শিবিরের ওপর। প্রত্যেকেই তোতা পাখির মত জামায়াতের প্রয়াত আমীর অধ্যাপক গোলাম আযমকে টেনে এনেছেন। ফিরে গিয়েছেন ১৯৯৮ সালে পিস্তল লিটনের গুন্ডামিকে নায়োকচিত রূপ দিতে। ফ্যাসিবাদি আচরণকে বৈধতা দিতে প্রত্যেক মিডিয়াই ছিল তৎপর।
মোড় ঘুরে যাওয়ার পরেও দোষী জামায়াত!
২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭। হঠাৎ করেই ঘুরে যায় পিস্তল লিটন হত্যার মোটিভ। গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের সাবেক এমপি ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা কর্নেল (অব.) আবদুল কাদের খানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করে জামায়াত শিবিরের নেতা-কর্মীদের ওপর অবর্ণনীয় তান্ডব চালিয়েছিল পুলিশ, সেই পুলিশই দাবি করে বসে- লিটন হত্যার ‘মূল পরিকল্পনাকারী’ কাদের খান।
কর্নেল (অব.) আবদুল কাদের খান কাদের খান জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের সাবেক সাংসদ। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেছিলেন তিনি।
ঘটনা যাই ঘটুক, মুখ তো রক্ষা করা দরকার! তাই এমপি পিস্তল লিটন হত্যার সাথে যেসব মিডিয়া জামায়াত-শিবিরকে জড়িয়ে খবর প্রচার করেছিল তারা কি বসে থাকবেন? না, তারা বসে থাকেননি। কুমিরের খাঁচ কাটা লেজের গল্পের মত তারাও গল্পটা আবার ঘুরিয়ে লিখলো।
তারা লিখলো- ‘১৯৯৮ সালে বামনডাঙ্গা কলেজ মাঠে গোলাম আযমের জনসমাবেশ ঠেকানোর মাধ্যমে জামায়াতের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে লড়াই শুরু করেছিলেন তিনি। তখন থেকেই তিনি জামায়াত-শিবিরের প্রধান শত্রুতে পরিণত হন। ২০১৩ সালে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর জামায়াতকে পুরোপুরি কোণঠাসা করে ফেলেন। জামায়াত-শিবিরও তাকে একমাত্র পথের কাঁটা মনে করত। যে কারণে বিভিন্ন সময় নানা ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি তাকে দেখে নেয়ারও হুমকি দিয়েছিল তারা। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সাবেক এমপি কর্নেল কাদের তার সহযোগীদের নিয়ে এমপি লিটনকে হত্যা করেন।’
এমন লিখনির জন্য এসব সাংবাদিককে সাংবাদিকতায় বিশ্বের সর্বোচ্চ পুরস্কার পুলিৎজার দেয়া যেতেই পারে।
গাইবান্ধা-১ আসনের সাংসদ মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যা মামলার রায় বৃহস্পতিবার ঘোষণা করা হয়। রায়ে সাতজনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। রায় ঘোষণা উপলক্ষে প্রধান আসামি আবদুল কাদের খানসহ অন্যদের কড়া নিরাপত্তায় আদালতে আনা হয়। জেলা ও দায়রা জজ আদালত এলাকা, গাইবান্ধা, ২৮ নভেম্বর।
রায় হলো আজ:
এমপি পিস্তল লিটন হত্যার রায় হলো আজ। আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে গাইবান্ধা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক দিলীপ কুমার ভৌমিক এই রায় দেন। সাবেক সাংসদ কর্নেল (অব) আবদুল কাদের খানসহ সাত আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন জাতীয় পার্টির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) আবদুল কাদের খান, তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) মো. শামসুজ্জোহা, গাড়িচালক আবদুল হান্নান, গৃহকর্মী মেহেদী হাসান, শাহীন মিয়া ও আনোয়ারুল ইসলাম রানা এবং সুন্দরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক চন্দন কুমার সরকার।
এর মধ্যে কাদের খানসহ ছয়জন আসামি আদালতে উপস্থিত ছিলেন। অপরজন উপজেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক চন্দন কুমার সরকার ভারতে পলাতক অবস্থায় সেখানে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাকে দেশে আনার প্রক্রিয়া চলছে।